২০০৭ সালের ১৬ জুলাই দিনটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের গনতন্ত্রের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে। এইদিনে এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকার গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারের আগে শেখ হাসিনার নামে দেয়া হয় একাধিক মিথ্যা মামলাও। নানা অজুহাতে তাকে বন্দী রাখা হয় জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ কারাগারে।
এছাড়াও সে সময় দলের অনেক সিনিয়র নেতাকর্মীও মঈনউদ্দীন-ফখরুদ্দীনের ‘পেটুয়া বাহিনীর’ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলে আওয়ামীলীগের দলীয় কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।
‘মঈনউদ্দীন-ফখরুদ্দীনের ‘পেটুয়া বাহিনীর’ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলে আওয়ামীলীগের দলীয় কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে’
এই সুযোগে একাত্তরের পরাজিত শক্তি তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। দেশী-বিদেশী নানা গোষ্ঠী ব্যস্ত হয়ে পড়ে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা এনে কিভাবে শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে নির্বাসনে পাঠানো যায়।
কারণ শেখ হাসিনাকে নির্বাসনে পাঠালেই আর্মি শাষনের ‘পাকিস্থানি ভুত’ বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া সহজ হয়ে যাবে। দেশ জুড়ে শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা। সুযোগটি কাজে লাগায় বিএনপি-জামাতপন্থী ব্যবসায়ীরা।
ভোগ্য পণ্যের দাম আকাশ ছুঁলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে সব শ্রেণী পেশার মানুষদের মাঝে; ফলে পুরনো প্রবাদ সত্যি হয়ে ফিরে আসে যে, আওয়ামীলীগ হেরে গেলে, হেরে যায় বাংলাদেশ।
‘আওয়ামীলীগ হেরে গেলে, হেরে যায় বাংলাদেশ’
এই সময়ে বাংলাদেশের ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আরো স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট।
ঢাবি ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি শেখ সোহেল রানা টিপু ভাই ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাকিব বাদশা ভাইয়ের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য সারা দেশের ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধ্য হয়ে রাজপথে নেমে আসে।
শেখ সোহেল রানা টিপু ভাইয়ের কথা আলাদা ভাবে বলতে হয়। ছাত্রলীগের এই অতন্দ্র প্রহরীর জন্য আজ গর্ব হয়, দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূর্দিনে পাশে থাকার সবচেয়ে বড় আন্দোলনটিতে সেদিন তিনি জীবন বাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার মুক্তির লক্ষ্যে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ সোহেল রানা টিপু এবং সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাকিব বাদশার নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল হয়।
মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন থেকে শুরু হয়ে সূর্যসেন হলের সামনে এসে প্রতিবাদ সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। সেই মিছিলে স্লোগান ধরেছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম ভাই, মিছিলে নেতৃত্বদানকারী আরেকজন ছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক জসিম উদ্দিন ভুইয়া।
ছাত্রলীগের সাবেক তিন যুগ্ম সাধারন সম্পাদক, সূর্য সন্তান মুস্তাক ভাই, মামুন ভাই ও রাহাত ভাইসহ মিছিলে ছিলেন ছাত্রলীগ থেকে এক সময় অভিমানে চলে যাওয়া তৎকালীন কবি জসিম উদদীন হলের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দীন ভাই, জহুরুল হক হলের বেকুল ভাই, শহিদুল্লাহ হলের সাবেক সভাপতি মুন্নাভাই, বর্তমান ছাত্রলীগের সহ সভাপতি কাজী এনায়েত ভাই ও আনোয়ার হোসেন আনু ভাই, বর্তমান ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ভাই, আনোয়ার হোসেন আনু ভাই, হাসানুজ্জামান তারেক ভাই, জিয়া হলের জিকু ভাই, মুহসীন হলের রাশেদ ভাই, মহিউদ্দীন ভাই, কর্ণেল ভাই, সাইফুল ভাই, মাহী ভাইসহ অনেকেই। সেনাবাহিনীর ভয়ে যখন সব দলের সব শ্রেণীর নেতাকর্মীরা ভীত-সন্ত্রস্ত ঠিক তখন এই সাহসী পদক্ষেপ ছিলো গণতন্ত্রের জয়যাত্রার প্রথম বীজ। আর সেই মিছিল সারাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের মাঝে এনে দিয়েছিলো তেজদীপ্ত প্রাণ।
সেই মিছিল ছিল সারা বাংলার ছাত্র সমাজের জন্য একটা ম্যাসেজ। ম্যাসেজটি ছিল, সেনা বাহিনীর চোখরাঙানি উপেক্ষা করে শেখ হাসিনাকে মুক্ত করতেই হবে। সেই মিছিল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে অন্যান্য সংগঠন মিছিল বের করন। সেই মিছিলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
তৎকালীর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহ্ফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন শেখ হাসিনার মুক্তির জন্যে কারাগার থেকে চিঠি লিখে নেতাকর্মীদেরকে উজ্জীবিত করেন। শেখ হাসিনার প্রিজন সেল বাংলার মানুষ মেনে নিতে পারেনি.
শুধু তাই নয়, টিপু ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে সেসময় সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা রাজু, কুষ্টিয়ার সুমন, ইসলামী বিশ্বিবদ্যালয়ের কেরামত, গোয়াইন ঘাটের সাজু, তিতুমীর কলেজের হাবীব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাকসুদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিপায়ন সরকারসহ অনেকেই সেইদিন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা মাথায় নিয়ে ফেরার জীবনযাপন করেছে। শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী বাসায় ও হলে থাকতে পারে নাই। হলগুলো ছিলো ছাত্রদলের গুণ্ডাদের দখলে, ফলে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তখন পালিয়ে থাকতে হয়েছে আমাকেও।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধরী রোটনসহ আমাদের ৮ জন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা তখন কারাগারে বন্দী ছিল। তারপরও শুধু নেত্রীর মুক্তির জন্যই ছাত্রলীগ সেদিন সেনাবাহিনীর সাথে এক অসম লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
‘হলগুলো ছিলো ছাত্রদলের গুণ্ডাদের দখলে, ফলে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তখন পালিয়ে থাকতে হয়েছে আমাকেও’
কিন্তু আমাদের ইতিহাস যারা মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখেন, তারা হয়তো ঘৃণা করেন মমতা পাওয়ার যিনি যোগ্য তাকে। ফলে অতীতকে আমরা সত্যিকারের চেহারায় দেখতে পাই না।
আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনতে তৃনমূলের যারা সেদিন সংগ্রাম করেছিল, আজ তারা অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে। হাইব্রিডের ভীরে ভুলে যাচ্ছি দুর্দিনের কাণ্ডারিদের নাম। মাঝে মাঝেই সিদ্দীকি নাজমুল আলম, আবু আব্বাস, আহসানউল্লাহ বাসারদের কথা মনে পড়ে। নেত্রীর মুক্তির প্রশ্নে, সেদিন যারা আন্দোলন করেছিল তাদের অনেকের নাম হয়তো বাদ পড়েছে, তারা আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
তবে আমরা ভুলে গেলেও সেনা অপশাষনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েই ছাত্রলীগকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলেননি মমতাময়ী মা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আন্তজার্তিক মহল, তৃণমূল নেতাকর্মী এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্দোলনের চাপে আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সেনা সমর্থিত সরকার। এছাড়াও সুন্দরভাবে আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য ছাত্রলীগের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ মুক্তি পেয়েই চিকিৎসার উদ্দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যান শেখ হাসিনা।
সেখানে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি কান এবং চোখসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা শেষে একই বছরের ৬ নভেম্বর দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। কয়েক দফায় জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর পর নানা টালবাহানা শেষে দীর্ঘ ১১ মাস কারাবরণ করে ১১ জুন ২০০৮ সালে মুক্তি পান।
নেত্রী শেখ হাসিনা যেদিন ছাড়া পেলো সেদিন ছাত্রলীগের যে অল্পকয়জন নেতাকর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলো, সেখানে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ধানমন্ডী ৫ নাম্বারে নেত্রীর বাসার সামনে অবস্থান নিয়ে বসেছিলাম আমরা। ফলে খুব কাছ থেকে দেখেছি দেশের জন্য কতটা ভালোবাসা জমানো আছে শেখ হাসিনার হৃদয়ে। পরবর্তী সময়ে দেশের জন্য এই একই ভালবাসা ধারণ করে আমিও ছাত্ররাজনীতি করেছি .
এই সময়ে এসে এখন মনে হয়, হয়তো হাইব্রিডদের ভিড়ে, অনুপ্রবেশকারীদের আধিক্যে, আর সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম্যে আমাদের আওয়ামীলীগ আপনাদের প্রাপ্য স্থানটুকু বুঝিয়ে দেবার কথা ভুলতে বসেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস মমতাময়ী মা দেশরত্ন শেখ হাসিনা আপনাদের অবদান কোনদিনই ভুলবেন না, ভুলতে পারেন না। আপার সাফল্যের প্রত্যেকটি স্তম্ভের সবচাইতে উজ্জ্বল স্থানটাতেই তিনি আপনাদের স্থান দিবেন। আমি নিশ্চিত আমাদের আপা আপনাদের মাঝেই তার আস্থা, বিশ্বাস আর ভালোবাসার মেলবন্ধন খুঁজে পান।