ষোল বছর ধরে আ.লীগ সভাপতি পদে রাজাকার

ডেস্ক রিপোর্টার, প্রকাশ: ২০১৯-১১-০৯ ১৬:০৭:১৩

ষোল বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে রয়েছেন রাজাকারের সন্তান ‘রাজাকার’। দলের শীর্ষ পদে ‘রাজাকার’ থাকলেও এ নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিল না আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের।

কিন্তু সম্প্রতি রাজাকার-অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা করার পর কুম্ভ কর্ণের ঘুম ভাঙেছে নেতাকর্মীদের। সেই সঙ্গে দলীয় কাউন্সিল নিকটবর্তী হওয়ায় দলের একটি অংশ রাজাকার হঠাও ইস্যুতে সরব হচ্ছে।

হঠাৎ আলোচনায় আসা এ রাজাকার সভাপতির নাম আব্দুল হাসিব মনিয়া। তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি।

৭১’র সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় উপজেলার খাসা দিঘিরপাড় এলাকার আব্দুল খালিক ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। আর তারই ছেলে আব্দুল হাসিব মনিয়া ছিলেন আল-বদর।

যুদ্ধকালীন সময়ে মনিয়ার বয়স তখন ২০-২২ বছর। তিনি পাকিস্তানীদের জন্য রসদ যোগাতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার আল-বদরদের হাতে খুন হন জামাল উদ্দিন নামের এক আওয়ামী লীগ কর্মী। ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অন্যতম একজন উপজেলা আওয়ামী লীগের এ সভাপতি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট জেলা ইউনিট কমাণ্ড প্রকাশিত ‘রণাঙ্গনে ৭১’ বইটিতে বিয়ানীবাজার উপজেলার তালিকায় ২৩৩ নাম্বারে আছে আব্দুল হাসিব মনিয়ার নাম এবং তালিকার ২২৩ নাম্বারে আছে তার বাবা আব্দুল খালিকের নাম।
মুক্তিযোদ্ধা জেলা ইউনিট কমাণ্ডের সাবেক কমাণ্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল সম্পাদিত রনাঙ্গনে ৭১ বইটিতে এও উল্লেখ রয়েছে আব্দুল হাসিব মনিয়া ১৯৭১’ সালের ১৭ জুলাই স্থানীয় স্বাধীন সুন্দরীর পিতা জামাল হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সদস্য।

এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার ক্যাপ্টেন মণ্ডুল’র জন্য খাবারের টিফিন বহন করে নিয়ে যেতেন মনিয়া। এ জন্য এলাকায় তাকে ‘টিফিন কিয়ারী রাজাকার’ বলেও ব্যঙ্গ করেন স্থানীয়রা।

২০০৪ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে মনিয়া সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। দীর্ঘ ষোল বছর উপজেলা আওয়ামী লীগের চালকের আসনে রয়েছেন তিনি। আগামি ১৪ নভেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। সেই রাজাকার আব্দুল হাসিব মনিয়া এবারও কাউন্সিলে ফের সভাপতি হতে চান। তার বিপরীতে সভাপতি পদে প্রার্থী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার ও সাবেক বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান।

সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হচ্ছেন- উপজেলার বর্তমান কমিটির প্রচার সম্পাদক হারুনুর রশিদ দিপু, সহ দপ্তর সম্পাদক দেওয়ান মাকসুদুল ইসরাম আউয়াল, সাংগঠনিক সসম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলের বিদ্রোহী প্রাথী হওয়া জাকির হোসেন, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক জামাল হোসেন।

সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়া সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ট মাকসুদুল ইসলাম আউয়ালও রাজাকারের সন্তান। তার বাবা কুটুচান্দ মেম্বার ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। রণাঙ্গনে ৭১ বইয়ের তালিকায় ২২১ নাম্বারে রয়েছে কুটুচান্দ মেম্বারের নাম। স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধারাও এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

মুক্তিযোদ্ধা জেলা ইউনিট কমাণ্ডের সাবেক কমাণ্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বলেন, একজন রাকাজার ষোল বছর ধরে স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে, এটা দু:খজনক। আব্দুল হাসিব রাজাকার ,তার বাপও রাজাকার (শান্তিকমিটির সদস্য) ছিল। সে ক্যাপ্টেন গণ্ডল’র দুপুরে টিফিন নিয়ে যেতো, এ জন্য তাকে এলাকায় টিফিন কিয়ারী রাজাকার বলা হয়।

তিনি বলেন, ৭১ সালে তার বাড়ির সামনে জামাল উদ্দিনকে গাছে বেধে হত্যা করা হয়। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হওয়া মকসুদুল ইসলাম আউয়ালের বাবা উপজেলার মুড়িয়া চান্দগ্রামের কুটুচান্দ মেম্বারও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।

এ বিষয়ে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান বলেন, দলে কোনো অনুপ্রবেশকারী, জামায়াত-বিএনপি,রাজাকার সন্তানদের ঠাঁই হবে না। এই বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছি।

রাজাকার আব্দুল হাসিব মনিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তাকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য রয়েছে। তারপরও বিতর্কিত কাউকে সংগঠনে না রাখার বিষয়ে গুত্বারুপ করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে বিয়ানীবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল হাসিব মনিয়া বলেন, দ্বিতীয় বারের মতো সভাপতি পদে প্রার্থী হচ্ছি। লোকজন চায় আমি প্রার্থী হই। কেননা, ১৯৬৬ সাল থেকে আমি আওয়ামী লীগে আছি। ৬দফার পর থেকে রাজনীতিতে সক্রিয়। উনসত্তোর, সত্তোরের নির্বাচনে তিনি নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন। তখন মোটরসাইকেল নিয়ে ভারতে যাই। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধের সময় এসে পাঞ্চাবীর হাতে ধরা খেয়ে সম্পত্তি খুইয়ে ৫মাস গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ শ্বশুড় বাড়িতে ছিলাম। শ্বশুড়বাড়ি থাকাকালে জামাল হত্যার ঘটনা ঘটে। জামালকে নিজের কর্মী হিসেবে দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা দক্ষিণে মুক্তিবাহিনীকে অভ্যর্থনা জানাই। এরপর সেখান থেকে বাড়িতে ফিরি। দেশ স্বাধীনের পর সিলেট ও বিয়ানীবাজারে ১০/১২টি বই ছাপা হয়। সেসব বইয়ে আমাকে মুক্তিযোদ্ধের সংগঠন দেখানো হয় দাবি করেন তিনি।

মনিয়া বলেন, বিগত পৌরসভা নির্বাচনের পর সুব্রত চক্রবর্তীকে ম্যানেজ করে বইয়ে তার নাম দেওয়া হয়। এ বিষয়ে বই বাতিল এবং দুই কোটি টাকা ক্ষতি পূরণ চেয়ে মামলা করেছি। ওই মামলার ডিক্রী পেলে মানহানি মামলা করবেন, পরামর্শ দিয়েছেন তার আইনজীবী। বইতে নাম আসার পর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে তাকে যুদ্ধাপরাধে জড়িত নয় বলেও প্রত্যা্য়ন পত্র দেয়। নির্বাচন এলেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়, দাবি করেন তিনি।