বাংলাদেশের বাজারে একটি সিলিং ফ্যানের মূল্য এক লাখ এক হাজার টাকা! বিটিসিএলের একটি প্রকল্পে এরকম ৪৫০টি ফ্যান কেনার জন্য তাই মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় চার কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এভাবে বিভিন্ন খাতে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে ‘মর্ডানাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ফর ডিজিটাল কানেকটিভিটি’ বা ‘ডিজিটাল সংযোগ সম্প্রসারণে টেলিযোগাযোগ অবকাঠামোর আধুনিকায়ন’ (এমওটিএন) প্রকল্পে।
২০১৫ সালের মার্চ থেকে প্রকল্পটি গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে সমালোচনার মুখে গত ৪ এপ্রিল একনেক সভা থেকে এর ‘বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাব’ (ডিপিপি) প্রত্যাহার করা হয়। এখন আবারও তা একনেকে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে টেলিযোগাযোগ খাতের সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী চক্র। অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয়ে বিনা টেন্ডারে চীনের প্রতিষ্ঠান জেডটিইকে কাজ পাইয়ে দেওয়াই সংশ্লিষ্টদের মূল লক্ষ্য। তাই এ প্রকল্প গ্রহণের উদ্দেশ্যও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
এর আগে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমও অতিরিক্ত ব্যয় এবং বিনা টেন্ডারে এ প্রকল্পের কাজ একটি কোম্পানিকে দেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। এরপরও অতিরিক্ত ব্যয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা যুক্ত রেখে একনেকে এর প্রস্তাব পাঠানো হয়।
প্রভাবশালী মহলের তৎপরতার মুখে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী বিটিসিএলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে এখন মুখ খুলতে চাইছেন না।
অতিরিক্ত ব্যয় যেভাবে: ২০১৫ সালের মার্চে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিটিসিএল ডিজিটাল যোগাযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এমওটিএন প্রকল্প নেয়।
এরপর একই বছরের ২৯ মার্চ ঢাকার চীনা দূতাবাস থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে একটি চিঠি আসে। এতে প্রকল্পের জন্য চীনের ঋণ দেওয়ার কথা জানিয়ে চীনা কোম্পানি জেডটিইকে যোগ্য বিবেচনা করে কাজ দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাপানি সহায়তায় টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (টিএনডিপি) থেকে অনিয়মের অভিযোগে জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকা ঋণ প্রত্যাহারের পর একই ধরনের নেটওয়ার্ক উন্নয়নকাজের জন্য এই এমওটিএন প্রকল্প নেয়।
দেখা যায়, টিনডিপি প্রকল্পে লট-বি অংশে নেটওয়ার্ক উন্নয়নের জন্য মোট ব্যয় ছিল প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। এমওটিএন প্রকল্পেও প্রায় একই ধরনের উন্নয়ন ও কারিগরি কাজের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যদিও এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় দুই হাজার ৪৮ কোটি টাকা।
চীনা কোম্পানি জেডটিইর সঙ্গে বিটিসিএলের দরকষাকষি কমিটির আলোচনায় এবং ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিটিসিএল-জেডটিই চুক্তিতে ২৩১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। অথচ এর আগে অপর একটি চীনা কোম্পানি এ প্রকল্পের জন্য মোট ব্যয় ১৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় এক হাজার ১৬০ কোটি টাকা উল্লেখ করে একটি প্রস্তাব দেয়।
২০১৬ সালের ১২ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠানো একটি চিঠিতে চীনা কোম্পানির ওই ব্যয়ের হিসাব (১৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সংযুক্ত করে জেডটিইর সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যয়ের তারতম্যের দিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যদিও পরে এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়ে জেডটিইর সঙ্গে চুক্তি করে বিটিসিএল।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৪৫০টি সিলিং ফ্যান বা বৈদ্যুতিক পাখা কেনার জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় চার কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর ফলে প্রতিটি পাখার দাম পড়ছে প্রায় এক লাখ এক হাজার টাকা! এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ‘জিপন’ যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে প্রতিটির মূল্য ১০১ মার্কিন ডলার দেখানো হয়েছে।
অথচ আন্তর্জাতিক বাজারের একাধিক কোম্পানির খুচরা মূল্য থেকে দেখা যায়, এর মূল্য বর্তমান বাজারে ৪৫ থেকে ৫০ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া এখনও বিটিসিএলে আগের একটি প্রকল্পের জন্য কেনা প্রায় এক লাখ জিপন পড়ে আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ মজুদ বিবেচনায় নিলে মোট ব্যয় আরও অনেক কমে আসত। কিন্তু বাস্তবে তা করা হয়নি। এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় দেখিয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা।
একনেক থেকে প্রত্যাহার, তবুও তোড়জোড়: অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণসহ কয়েকটি বিষয়ে বিটিসিএলের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
এ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিটিসিএল চেয়ারম্যান প্রতিষ্ঠানটির উত্তরপত্রের সঙ্গে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বোর্ড সভার কার্যবিবরণী সংযুক্ত করে পাঠান। বোর্ড সভার ওই কার্যবিবরণীতেও জেডটিইর সঙ্গে চুক্তির সপক্ষে এবং অতিরিক্ত ব্যয়ের পক্ষেই মত দেওয়া হয়। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে পাঠানো চিঠিটির জবাবে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহফুজ উদ্দিন আহমেদ লেখেন, ‘সংযুক্ত ব্যাখ্যার সঙ্গে বিটিসিএল একমত পোষণ করে।’
পরে গত ৮ মার্চ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে চীনা সহায়তায় গ্রহণ করা প্রকল্পে বিনা টেন্ডারের পরিবর্তে ‘লিমিটেড টেন্ডার’ বা সীমিত আকারে একাধিক চীনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দরপত্রের ব্যবস্থা করার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে অনুরোধ জানান। চিঠিতে প্রকল্পটি আপাতত বাতিলেরও পরামর্শ দেন তিনি।
গত ২০ মার্চ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এ চিঠির উত্তরে জানান, তিনিও (টেলিযোগাযোগমন্ত্রী) শুরু থেকেই এ প্রকল্পের জন্য লিমিটেড টেন্ডার পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন। একই সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীন একাধিক প্রকল্পের একটি তালিকা দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোন প্রকল্পের জন্য অর্থমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন, তা জানতে চান। যদিও প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া ওই তালিকায় শুধু এমওটিএন প্রকল্পের পাশেই চীনা সহায়তার কথাটি উল্লেখ ছিল।
কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ৮০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য একনেকে গত ৪ এপ্রিল চিঠি পাঠানো হয়। একনেকের ওই সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, সভার শুরুতেই এ প্রকল্প প্রত্যাহার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ খাতের একটি প্রভাবশালী চক্র প্রকল্পটি অতিরিক্ত ব্যয়েই চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এখনও তৎপর রয়েছে। সমালোচনার মুখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় এবং মূল্য পুনর্বিন্যাস করলেও মোট ব্যয় সেই ২৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেখেই প্রকল্পটি পুনরায় একনেকে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রভাবশালী চক্রের কর্তাব্যক্তিরা এ জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে অর্থ বিভাগ, এমনকি পরিকল্পনা কমিশনেও দৌড়ঝাঁপ করছে। যদিও ঋণ থেকে আসা এ প্রকল্পের ব্যয় বাড়লে ঋণের বোঝাও বেড়ে যাবে।